Search This Blog

Friday, January 11, 2019

রনজিত কুমার এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে / রফিউর রাব্বি

রনজিত কুমার এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে
/ রফিউর রাব্বি

‘মৃত্যুর পূর্বে পাখি / নীরবে চলে যায় একাকী / একথা কি জেনে গেছে সবে? / আমিও চলে যাব একাকী ঐ নির্জনে/ জীবনের সঞ্চিত ধন দিয়ে যাব সব / এই নাও আমার বুকপকেট / দেখো কত শত নাম লেখা আছে ভালবাসার ঘামে...’ এভাবেই রনজিত কুমার তাঁর জবানবন্দী লিপিবদ্ধ করেছেন জীবনের এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। কবিতার শিশিরে যেমনি ভেজাতে চেয়েছেন দুপুরে ঝরে পড়া দুঃখের শুকনো পাতা, আবার প্রচণ্ড উন্মাতাল রোদে তুলতে চেয়েছেন বিদ্রোহের ঢেউ। রনজিত তাঁর জীবন নিঙরেই এই ভালবাসার বিষ তৈরি করেছেন। প্রচলিত পথ না মাড়িয়ে বিচিত্র এক পথে জীবনকে ছুঁড়ে দিয়েছেন। যেখানে সাহস করে কেউ যায় না কখনও; রনজিত সেই পথেই পা বাড়ালেন। যেখানে ঘরে থেকেও বাইরের, একা থেকেও সকলের।
নেত্রকোণার সুসং দুর্গাপুরের মাতুলালয়ে ১৯৬২ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি রনজিত কুমারের জন্ম। পিতা নারায়ণগঞ্জের কুমুদিনীতে কর্মরত রমেন্দ্র দাস, মা সবিতা রানী দাস। নারায়ণগঞ্জ বার একাডেমি থেকে এসএসসি, নটরডেম, ঢাকা থেকে এইচএসসি পাশ করে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজে ভর্তি হন রনজিত। রাজনীতি ও সাহিত্য-সংস্কৃতির সাথে ওতোপ্রোতভাবে জড়িয়ে পড়েন। ময়মনসিংহের সাহিত্য সংগঠন ‘বীক্ষণ’ এর আহ্বায়ক হন। বিপ্লবী ছাত্র আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন। ময়মনসিংহের কাশিয়ার চরে ভূমিহীনদের খাস জমি উদ্ধারের আন্দোলনে যুক্ত হয়ে সশস্ত্র সংর্ঘষে আহত হয়ে দীর্ঘদিন হাসপাতালে থাকেন। সুস্থ হয়ে পুনরায় ব্রহ্মপুত্রের পাড়ে ভূমিহীনদের জন্য খাস জমি উদ্ধারের আন্দোলন করে গ্রেপ্তার হন। আর এরই মধ্যে চুকে যায় তাঁর অসমাপ্ত চিকিৎসাবিজ্ঞানের পাঠ। পরে মানবিক নিয়ে স্নাতক সম্পন্ন করেন। দু’বছর কারাগারে থেকে ১৯৮৯ সালে মুক্তি পান।
১৯৯০ সালে নারায়ণগঞ্জে ফিরে আসেন। শুরু করেন শিশুদের সংগঠিত করার কাজ। ১৯৯২ সালে গড়ে তোলেন শ্রুতি সাংস্কৃতিক একাডেমি এবং পরে ধাবমান সাহিত্য আন্দোলন। এসব সংগঠনের মাধ্যমে নিয়মিত পাঠচক্র, সাহিত্য, আবৃত্তি, সংগীত, অভিনয়ে কর্মী গড়ে তোলার প্রক্রিয়ায় নিয়োজিত হন। কর্মীদের পরিবেশ সচেতন ও বিজ্ঞানমনস্ক করে তোলার জন্য নিয়মিত বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করেন। নারায়ণগঞ্জ সাংস্কৃতিক জোট, বাংলাদেশ আবৃত্তি সমন্বয় পরিষদসহ বিভিন্ন সংগঠনের সাথে জড়িয়ে পড়েন। কর্মজীবনে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের আউট রিচ প্রকল্পের সমন্বয়ক হিসেবে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল ঘুরে তুলে আনেন মুক্তিযুদ্ধের অনেক অজানা ইতিহাস। রনজিত কুমার কবিতা ও গদ্যে একাধারে বিচরণ করেছেন। লিখেছেন প্রবন্ধ, ছড়া, শিশু নাটক। তাঁর রয়েছে নারায়ণগঞ্জের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে শিশুদের জন্যে গবেষণা গ্রন্থ। ২০১২ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম ও একমাত্র কবিতাগ্রন্থ ‘এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে’, প্রবন্ধ-নিবন্ধ নিয়ে ‘চৌহদ্দির রিনিঝিনি’ প্রকাশিত হয় ২০১৬ সালে। ২০১৭ সালে ‘মুক্তিযুদ্ধের কিশোর ইতিহাস : নারায়ণগঞ্জ জেলা’ প্রকাশিত হয়। সম্পাদনা করেন গ্রন্থ - ‘সম্ভূমানব কথা’। বিভিন্ন সময়ে সম্পাদনা করেন লিটল ম্যাগাজিন ‘ধাবমান’ ও বিজ্ঞানপত্রিকা ‘এটম’। রনজিত অস্থির সময়ে নিজের অস্থিতিশীল জীবনের দায় স্বীকার করেছেন অকপটে। বলেছেন, ‘যৌবনে নেহায়েত শখের বশে কবিতার ভূবনে ছোটাছুটি করেছি। সে বিচরণের ফসল সংরক্ষণ করতে পারিনি নিজের অস্থিতিশীল জীবনের জন্য। বারবার হারিয়ে গেছে তা।’
১৯৯৭ সালে রনজিত প্রকৃতিবিজ্ঞানী দ্বিজেন শর্মার ভ্রাতুষ্পুত্রী সঞ্চিতা শর্মাকে বিয়ে করেন। সঞ্চিতা শর্মা বর্তমানে বড়লেখার সুজয় নগর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা। তাঁদের দুই সন্তান- প্রথম প্রান্ত (১৯) ও অনন্ত উৎসাহ (১৭)। সমাজের প্রচলিত প্রথা ও অচলায়তন ভাঙার দুর্মর এক তাগিদ রনজিতকে সবসময় তাড়িত করেছে। তরুণ-তরুণীদের কূপমণ্ডুকতা ও ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে দাঁড়াতে প্রাণিত করেছে। এক উদ্ভট উটের পিঠে চড়ে বসা স্বদেশকে মাটিতে নামিয়ে আনার প্রত্যয়ে রনজিত সর্বদা সচেষ্ট থেকেছেন। আর তাই সংস্কৃতিহীন রাজনীতি ও রাজনীতিহীন সংস্কৃতির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে এ দুইয়ের দূরত্ব ঘোচাতে শেষাবধি সক্রিয় ছিলেন। তা করতে যেয়ে অপ্রচলিত অনিরুদ্ধ এক জীবন বয়ে চলেছেন। যা নির্মোহ, নির্বাণ ও বোহেমিয়ান।
কিছুদিন আগে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে বঙ্গবন্ধু মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হন। গত ২ জানুয়ারি অস্ত্রোপচার হলে সেদিনই তাঁর কর্মময় জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটে যায়। রনজিতের ভাষায় ‘মোটামুটি ফল পাকার আগেই পেড়ে ফেলা হল / মোটামুটি গন্তব্যে পৌঁছার আগেই ব্রেক কষতে হল ...’ প্রকাশ্য রাজপথের কোলাহল ছাপিয়ে রনজিত কুমারকে ঘোষণা করতে হল - বিদায়।

No comments:

Post a Comment

সূর্য ডোবার খেলা

 সূর্য   ডোবার খেলা  এস_আর_শহীদ সাগর আকাশ মিলেছে যেখানে  রং ধনু সাত রং খুঁজে পাই সেখানে।।  সূর্য ডোবার খেলা দেখি দু'নয়নে কি দারুণ সুখে ন...